লঞ্চ নয় যেন চার তারকা হোটেল, লিফট-ডুপ্লেক্স কেবিন সবই রয়েছে

প্রথম দেখায় মনে হতেই পারে, কোনো চার তারকা হোটেলে ঢুকে পড়লেন না তো? চোখ ধাঁধানো কাঠের কারুকাজ, নান্দনিক ডিজাইন, আধুনিক সাজসজ্জা ও নজরকাড়া আধুনিক ঝাড়বাতি বার বার মুগ্ধ করবে আপনাকে। মনে হবে কোনো বিলাসবহুল ভবন কিংবা হোটেলেই ঢুকেছেন হয়তো। কিন্তু না এটি কোনো বিলাসবহুল ভবন কিংবা চার তারকা হোটেল নয়, এটি একটি লঞ্চের দৃশ্য।

বরিশাল-ঢাকা নদী পথে যাত্রীদের যাত্রা আরও আরামদায়ক করতে দেশের অন্যতম নৌযান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স মিতা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোং’ তৈরি করেছে বিলাসবহুল চার তারকা হোটেলের আদলে তৈরি আওলাদ পরিবারের সবথেকে বড় সদস্য এম.ভি প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চ। যেন নদীতে ভাসমান বিলাসবহুল চার তারকা হোটেল। প্রযুক্তিনির্ভর লঞ্চটিতে থাকছে চার তারকা হোটেলের যাবতীয় ব্যবস্থা। অসাধারণ নির্মাণশৈলীর সুনিপুণ প্রদর্শনীর কারণে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এটি লঞ্চ নাকি চার তারকা হোটেল।

যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে লঞ্চটিতে রয়েছে বিনোদন স্পেস, বড় পর্দার টিভি, স্যাটেলাইট অ্যান্টেনার মাধ্যমে টেলিভিশনে সরাসরি দেড়শ চ্যানেল দেখার ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, ইন্টারকম যোগাযোগের ব্যবস্থা, রেস্টুরেন্ট, উন্মুক্ত ওয়াইফাই সুবিধাসহ বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা।

এছাড়াও এই বিলাসবহুল লঞ্চের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো সম্পুর্ণ লঞ্চে সিড়ির পাশাপাশি চলাফেরায় অক্ষম শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সুবিধার জন্য থাকছে লিফটের ব্যবস্থা। লঞ্চের চতূর্থ তলায় রয়েছে নামাজের জন্য মসজিদের ব্যবস্থা। মসজিদটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন একজন ইমাম। এছাড়াও রয়েছে ছোট লাইব্রেরি, চাইনিজ রেস্তোরাসহ আরও অনেক কিছু।

লঞ্চটির আলোকসজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে বেশ কিছু নজরকাড়া আধুনিক ঝাড়বাতিসহ বিভিন্ন ধরনের এলইডি লাইট। আলোকসজ্জার পাশাপাশি পুরো লঞ্চ, বিশেষ করে কেবিন ও করিডোরে চোখ ধাঁধানো কাঠের কারুকাজ মুগ্ধ করবে সকলকে। দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যের সঙ্গে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সব কিছুই রয়েছে লঞ্চটিতে।

প্রায় ৮৬ মিটার দৈর্ঘ্যে আর ১৪.৫ মিটার প্রস্থের এ লঞ্চটির নির্মাণে কাঁচামাল ইস্পাতের তৈরি নতুন পাত বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। দু’স্তরবিশিষ্ট স্টিলের মজবুত তলদেশ থাকায় দুর্ঘটনায় তলদেশ ফেটে লঞ্চডুবির আশঙ্কা নেই বললেই চলে। লঞ্চটির ডেকের তলদেশে পৃথক কম্পার্টমেন্ট বা হাউজ সিস্টেম করা হয়েছে। যাতে দুর্ঘটনায় তলদেশের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে অপর অংশে পানি প্রবেশ না করতে পারে এবং লঞ্চটি নিরাপদে চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। এছাড়া যাত্রীদের নিরাপত্তায় লঞ্চে আধুনিক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, লাইফ জ্যাকেট-বয়াসহ পানিতে ভেসে থাকার সকল আধুনিক সরঞ্জামই রয়েছে।

নৌযানটিতে রয়েছে ১৪৮০ এইচপির জোড়া ডাইহাটসু ইঞ্জিন। যার কারণে লঞ্চটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২০ নটিক্যাল মাইল বেগে ছুটতে সক্ষম হবে। এছাড়া সম্পুর্ন লঞ্চটি মেকানিক্যাল ও ইলেক্ট্রো হাহড্রোলিক সুকান সিস্টেমসহ মাষ্টার ব্রীজে প্রয়োজনীয় আধুনিক সকল ইকুইপমেন্ট দ্বারা নির্মিত। চলার সময় নদীর গভীরতা জানতে লঞ্চের সামনে ও পেছনে দুটি ইকোসাউন্ডার বসানো হয়েছে। এছাড়া রাডারসহ লঞ্চ চালনায় আধুনিক বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। লঞ্চটি দেড় হাজার যাত্রী বহন করতে পারবে এবং পর্যাপ্ত পণ্যও পরিবহন করতে পারবে।

চারতলা এ লঞ্চটির বিজনেস ক্লাসে রয়েছে বিলাসবহুল ৮ টি ভি.আই.পি কেবিন। যার প্রতিটি কেবিন রয়েছে অ্যাটাচ বাথ ও বারান্দাসহ শীতাতপ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা। ভিআইপি কেবিনের আরও একটি আকর্ষনীয় দিক হলো, এই লঞ্চে রয়েছে ডুপ্লেক্স কেবিন ব্যবস্থাও। তৃতীয় ও চতুর্থ তলার সংযোজন হয়েছে এই ডুপ্লেক্স কেবিনে।

যাত্রীদের বাজেট এবং অন্যন্য সুযোগ সুবিধার কথা ভেবে নৌযানটিতে এসি/নন এসি মিলিয়ে মোট ১২৪টি সিঙ্গেল কেবিন ও ৭০টি ডাবল কেবিন রয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে সেমি ভি.আই.পি কেবিন ও ফ্যামিলি কেবিন। প্রতিটি শ্রেণির কেবিনগুলো বানানো হয়েছে বিলাসবহুল আবাসিক চার তারকা হোটেলের আদলে। ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন আসবাবপত্রে সাজানো প্রতিটি কক্ষ। প্রতিটি কেবিনের সঙ্গে রয়েছে সুবিশাল বারান্দা। এখানে বসে চাইলেই উপভোগ করা যাবে নদীর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য।

লঞ্চটিতে ডেকের যাত্রী থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর যাত্রীদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত মোবাইল ফোন চার্জের ব্যবস্থা ও পরিশুদ্ধ পানি, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও বিনোদনের জন্য এলইডি টেলিভিশনের ব্যবস্থা।

আওলাদ শিপিং লাইন্সের মহাব্যবস্থাপক মাহফুজুল হক মাসুম জানান, লঞ্চটিতে নিরাপত্তার দায়িত্বে সর্বদা তিনজন আনসার সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়াও যাত্রী সেবার জন্য থাকবে ২৮ জন কেবিন বয়। পুরো লঞ্চটি সিটিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।

দৃষ্টিনন্দন এই লঞ্চটির প্রধান আর্কিটেক্টের ভূমিকায় থাকা চৌধুরী আরিফ উল আলম বলেন, জাহাজ কর্তৃপক্ষের চাহিদা এবং যাত্রীদের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা জাহাজটির ইন্টেরিয়র ডিজাইন করার স্থানগুলোকে সাজানোর নকশা প্রণয়ন করি। সাধারণ ঘরানার ডিজাইনের মাধ্যমে যাত্রীদের প্রশান্তিদায়ক যাত্রা এবং যাত্রাপথে জাহাজের আভ্যন্তরীণ চলাফেরা ও আয়েশের দিক থেকে কোনরকম প্রতিবন্ধকতা না আসে- এই বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে ইন্টেরিয়র সাজানোর চেষ্টা করি। আমরা আশা করছি প্রিন্স আওলাদ-১০ জাহাজের ইন্টেরিয়র ডিজাইন যাত্রীদের চাহিদার সবটুকুই পূরণ করবে এবং রাতের নৌযাত্রাকে রোমাঞ্চিত করবে।

লঞ্চটির কর্নধার ও পরিচালক যুবরাজ হোসেন শিশির জানান, প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চটি তৈরির সময় যাত্রী ও নৌযানের নিরাপত্তার বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া লঞ্চটির নির্মানকাজ প্রায় দুই বছর ধরে চলেছে। আমাদের নৌযানটিতে রয়েছে অত্যাধুনিক Co2 নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনরুম। যেটা বাংলাদেশে আমরাই প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেছি। এর ফলে লঞ্চের ইঞ্জিনরুমে কখনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে মাত্র ৩০ সেকেন্ডেই সেই অগিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। আমি যাত্রীদের আহ্বান জানাবো, আপনারা প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চটিতে ভ্রমণ করে বিলাসবহুল ভ্রমণ অভিজ্ঞতার স্বাদ নিবেন। আপনাদের নিরাপত্তা ও ভ্রমণকে আনন্দদায়ক করে তোলার জন্য সকল ব্যবস্থাই রয়েছে আমাদের নৌযানে।

উল্লেখ্য, গত রবিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) প্রথম বারের মতো ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশ্য যাত্রা করে প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চটি।

Back to top button